আমি কি কখনো মারা যাবো? – পাগল, হতেই পারে না।

ঠিক এমনটাই ভাবনা ছিলো যখন আমার বয়েস চৌদ্দ কি পনেরো। তখন মনে হতো পাহাড় থেকে লাফ দিলে কি আর হবে? স্পাইডারম্যানের মতো পায়ের এক হাঁটু ভাজ করে, ডান কিংবা বাম হাতে থাবড়ে নেবো মাটি। সমুদ্রে পড়ে গেলে হাঙ্গর হয়ে বালুতটে ফিরে আসবো। আর যদি শরীরে ঢুকে যায় কোন ধাতব ছুরি কিংবা বুলেট, সেগুলোও গলে যাবে মোমের মতো – কারন, চামড়ার নিচের রক্ত ছিলো ভয়ঙ্কর রকমের গরম।

জন্মে ছিলাম অসম্ভব রকমের জীবনীশক্তি নিয়ে।

হাজার হাজার লিটার রক্ত পাম্প করার জন্য শক্তিশালী হৃদপিণ্ড, টন কে টন বাতাস টেনে নেবার জন্য উড়োজাহাজের ইঙ্গিনের মতো ফুসফুস, দৌড়ে চলবার জন্য ইস্পাতের মতো শক্ত হাড়, অনুভুতির আবেশ উপভোগের জন্য বিদ্যুৎগতির স্নায়ুরাশি, হাজার হাজার টেরা বাইটের মস্তিস্ক – আরো কতকিছু।

কিন্তু, দিন যত এগিয়ে যাচ্ছে… একে একে শরীরের সব কলকব্জা কেমন যেন তার পারফরম্যান্স হারিয়ে ফেলছে। আমি এখন সেখানে, পুরোনো লোহার মেশিনের গায়ে জমে থাকা লালচে বাদামি রঙের মরিচার মতো দেখতে পাই।

দৃষ্টিশক্তি তো সেই কমতে শুরু করেছে ছোটবেলা থেকেই, কিন্তু কপাল ভালো চশমার লেন্সের পেছনে সেটাকে ঢেকে রাখতে পেরেছি। কিন্তু, চার পাঁচ বছর আগ থেকে যে ক্ষয়গুলো শুরু হয়েছে, সেগুলো বোধহয় আর কোন পেইন্টিং এ ঢেকে রাখা যাচ্ছে না। গরমিল হয়ে যাচ্ছে রসায়নেও – একদিকে যেমন এনামেল, ক্যালসিয়াম, এড্রেনালিন এর মতো জিনিসগুলো কমে যাচ্ছে, তেমনি আরেকদিকে বেড়ে যাচ্ছে শর্করা, কোলেস্টেরল।

জীবনে চলতে চলতে আমাদের শরীরটাও আস্তে আস্তে ক্ষয়ে যেতে থাকে।

একটা গাড়ি যেমন নতুন অবস্থায় রাস্তায় খুব ভালো দৌঁড়ালেও, একটা সময় এসে তার একেকটা পার্টসে ক্ষয়রোগ ধরে। ধসে পড়তে থাকে ইঙ্গিনের পিস্টন, চাকার ব্রেক প্যাড – ব্রেক সু, শক এবজর্ভার, স্টিয়ারিং হুইল। বাহিরের চকচকে মসৃণ রঙটাও ফ্যাকাসে হতে থাকে, কখনো কখনো রঙ উঠে বেরিয়ে পড়ে এলুমিনিয়ামের পাত। গাড়ির কিংবা যন্ত্রপাতি ক্ষয় তাও হয়তো জোড়াতালি দিয়ে কোন ভাবে চালিয়ে নেয়া যায়। কিন্তু, এই প্রাকৃতিক শরীরটা কেটে গেলে, ভেঙ্গে গেলে, ক্ষয়ে গেলে, পচে গেলে – আর আগের অবস্থায় ফিয়ে পাওয়া যায় না।

এই কদিন আগেই, আমার ছোট ছেলেটা, বয়েস নয়’এর একটু উপরে। সে বাসার নিচে খেলতে গিয়ে সামনের দাঁত দুটো ভেঙে ফেললো। বাসায় এলো কাঁদতে কাঁদতে। তার কান্নাটা ব্যথার ছিলো না, ছিলো ভয়ের। কারন, তাকে বলা হয়েছিলো এগুলো পার্মানেন্ট দাঁত। পড়ে গেলে কিংবা ভেঙে গেলে আর পাওয়া যাবে না। অনেক বুঝিয়ে তার ভয়টা কাটিয়ে দেয়া হয়েছে। কিন্তু, আমি জানি সে তার ভাঙা দাঁত আর কখনো ফিরে পাবে না। সমাধান হয়তো একটা আছে – “টুথ কম্পোজিট বন্ডিং”। তবে সেটা তো আর সব কিছু আগের মতো করে দিতে পারবে না।

প্রতিদিনই আমাদের কারো না কারো, শরীরের কোন না কোন পার্টস শাট ডাউন হয়ে যাচ্ছে। সেগুলো আর কখনোই ফিরে পাওয়া যাবে না। এটাই নিয়ম, মেনে নেওয়ার অবাধ্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
আমার এই লেখাটা পড়ে অনেকের মনে হতে পারে, এই জন্যই সময় থাকতে শরীরের দিকে নজর দিতে হবে, যত্ন করতে হবে। কিন্তু, তাতে আসলে খুব একটা লাভ হবে কি না জানা নেই। হয়তো, যন্ত্রগুলো কয়েকটাদিন বেশি সার্ভিস দেবে। গাড়ি ষাটের জায়গায়, আশিতে গিয়ে বন্ধ হবে। তবে, এটা ঠিক যে ভালো মতো যত্ন নিলে, যতদিন চলবে একটু কম যন্ত্রণা দেবে। দুম করে বন্ধ হয়ে যাবার রিস্কটা কমে যাবে।

আমি প্রতিদিন জীবনের এই কার্ভটাকে খুব মনোযোগ দিয়ে দেখার চেষ্টা করছি। কার্ভটা দেখতে অনেকটা ঢেউয়ের মতো। খুব আস্তে আস্তে শূন্য থেকে শুরু হয়ে উপরে উঠতে থাকে। একটা সময় চূড়ায় উঠে যায়। তারপর, আবার নামতে থাকে, শূন্যের দিকে। একটা সময়ে এসে মিলিয়ে যায় – ঠিক অনেকটা সূর্য যেভাবে উঠে, আবার ডুবে যায়। তবে, প্রতিদিন সূর্যের ডোবা যেমন আবির রঙে গোধূলির আকাশ রাঙাতে পারে না, তেমনি সবার এই ডুবে যাওয়াটাও একরকমের হয় না।

সেই সন্ধ্যাটাকে মাঝে মাঝেই বসে আমি কল্পনায় দেখার চেষ্টা করি। যখন আমার জীবনের সূর্যটা ডুবছে, আমি ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছি, আর কোনদিন ফিরে আসবো না বলে। কিছুক্ষন পরেই চারদিক ছেয়ে যাবে অন্ধকারে – ঠিক সেই মুহূর্তেই, আমার আকাশ কতটা রঙিন।

সেই গোধূলির, শেষ আলো – কারো মনে কি থেকে যাবে?
সেই গোধূলির, শেষ আলো – কারো মনে কি নতুন কোন স্বপ্নের রঙ ধরাবে?
.
.

লিখাটা প্রথম পাবলিশ করেছিলাম ফেসবুকে –


মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন
১১ এপ্রিল ২০২২

মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন

মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন

কবি, কথাসাহিত্যিক ও ছোট গল্পকার

 ফ্রি ই-বুক

রোম্যান্টিক উপন্যাস

সোশ্যাল মিডিয়া লিংক