কদিন আগের ঘটনা। আমি একটু গ্রামের বাড়ির দিকে গিয়েছিলাম, একটা ইফতারের প্রোগ্রামে।

আমার খাওয়া দাওয়া যখন শেষ হলো, তখন সন্ধ্যে পুরোপুরি নেমে গেছে। চারিদিক অন্ধকার। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম, প্রায় সাতটা বাজে।

আলো ঝলমলে ঢাকায়, এটা আসলে তেমন কোন রাত না। এই সময়টায় অনেকেই অফিস থেকে বের হয়ে নগরীর ব্যস্ত রাজপথে দাঁড়িয়ে থাকে, বাড়ি ফেরার অপেক্ষায়। কেউ কেউ ছোটে শপিং মলে দরকারি কিছু কেনবার জন্য। আর যাদের বাড়ির ফেরার তাড়া নেই, তারা মনে একটা ফুরফুরে ভাব নিয়ে কোন কফি শপের দিকে এগিয়ে যায়, প্রিয় কারো সাথে জমিয়ে আড্ডা দেবার আমেজে।

কিন্তু, আমি যেখানটায় ছিলাম, সেখানটার হিসেব সম্পূর্ণ আলাদা। এই সন্ধ্যে সাতটাতেই মনে হলো রাত দুটো বাজে। কিংবা আরো বেশি।শুধু বাড়ির ভেতরে, আর উঠোনে খানিকটা বিজলিবাতির আলো জ্বলে আছে। আশেপাশে গাঢ় অন্ধকার।

তেহারি খাওয়ার পর পরই শরীরে নিকোটিনের তীব্র টান উঠে গেছে। আমি চুপচাপ উঠোন পেরিয়ে মোবাইলের টর্চ জ্বেলে একটু বাইরের দিকে চলে এলাম। মনে হলো চারদিকে ঘুটঘুটে কালো পর্দা দিয়ে আমাকে কেউ ঢেকে দিলো। ডানে বামে সামনে, কিছুই দেখার উপায় নেই। শুধু পেছন ফিরে তাকালে, সামান্য আলো চোখে পড়ে।

এই অন্ধকারকে পূর্ণমাত্রায় উপভোগ করার জন্য আমি কাগজ মোড়ানো তামাকের পাতায় আগুন জ্বালিয়ে দিলাম। স্নায়ুগুলো সুখ অনুভব করতে শুরু করলো। আর ঠিক তখনই অদ্ভুত সুন্দর একটা গন্ধ আমার নাকে ভেসে এলো। কোন ফুল কিংবা পারফিউমের গন্ধ না। কেমন যেন ভেজা ভেজা তাজা একটা মিষ্টি গন্ধ।

বিকেলের দিকে এখানে আসার সময় কাছেই আমি অনেকগুলো লেবুর বাগান দেখেছি। সেখানে প্রচুর লেবু ছিলো। বাড়িটার একদিকে পুরোপুরি বাঁশ গাছ দিয়ে ঘেরা, আশেপাশে অনেকগুলো কাঁঠাল গাছ। সেখানে ছোট ছোট কাঁঠাল ধরে আছে। বেশ খানিকটা দূরে ভুট্টা ক্ষেত।

আমি মনে মনে ভাবছি কিসের হতে পারে এই গন্ধটা। এতো মাদকীয় একটা গন্ধ।

কেমন যেন দুম করে এই গন্ধটার প্রেমে পড়ে গেলাম। ইচ্ছে হলো জড়িয়ে ধরি। কিন্তু, কাকে জড়িয়ে ধরবো। এই মাতাল করা সৌরভকে বুকের ভেতর জড়িয়ে ধরার কোন উপায় আমার জানা নেই। তাই, চোখ বন্ধ করে, দু তিনবার বড় বড় শ্বাস টেনে গন্ধটা বুকের ভেতর ভরে নেবার চেষ্টা করলাম।

চোখ খুলতেই দেখি, খানিকটা দূরে ছোট একটা আলো জ্বলে আবার নিভে গেলো। প্রথমে ভাবলাম ওখানে কেউ দাঁড়িয়ে হয়তো আমার মতোই তামাক পোড়াচ্ছে। কিন্তু, সিগারেটের আগুনের আলো তো হলদে কমলা রঙের। আর আমি দেখছি, সবুজে নীলাভ আলো। তাহলে এটা কি?

ভাবতে ভাবতেই আমার চারপাশ ভরে উঠতে লাগলো সেই সবুজে নীলাভ আলোয়। আকাশে যেমন করে মিটমিট করে নক্ষত্রেরা জ্বলে, ঠিক তেমন করেই জ্বলছে এই আলো।

এই অন্ধকারে, অজানা অচেনা ঘাসফুলের গন্ধ বুকে নিয়ে আমি দাঁড়িয়ে আছি ছোট একটা বনের ভেতর। উপরে খোলা আকাশ। আর আমার চারপাশে বুনো আবেগে উড়ে বেড়াচ্ছে শত শত – জোনাকি।
আমার মন আনন্দে ভরে উঠলো।

কতদিন এমন সময় আসেনি। কতদিন এমন রাত দেখিনি।

ছোটবেলার একরাশ স্মৃতি আমাকে মুহূর্তের মধ্যে গ্রাস করলো।

.

আমি আমার অনেক লিখায়, ঘাসফুল আর জোনাকি পোকার কথা বলি।

মাঝে মাঝে ভাবি যে কখনো ঘাসফুলের গন্ধ বুকের ভেতর নেয়নি, কখনো নিজের চোখে জোনাকি পোকা দেখেনি, সে কি পারবে আমার লিখা কিংবা কবিতাগুলো অনুভব করতে।

আমার দুই ছেলে। দুজনেই ছোটবেলা থেকে ঢাকায় বড় হয়েছে। এই শহরের পিচঢালা রাস্তায় ঘাসফুল ফোটে না, নিয়ন আলোর ঝলকানিতে জোনাকি পোকা আসে না। তারা কখনো এই দুটো জিনিস দেখেনি।

তারা যদি কখনো আমার লিখা পড়ে। কখনো কি জানতে পারবে, এই আলোর পৃথিবীর বাইরেও আরেকটা পৃথিবী আছে –

যেখানে রাতের অন্ধকারে,
সবুজে নীলাভ আলো প্রজাপতি হয়ে উড়ে।
যেখানে মাটি থেকে আদিম আত্মার সৌরভ,
সুগন্ধ হয়ে ঘুরে।
.
.

লিখাটা প্রথম পাবলিশ করেছিলাম ফেসবুকে –

মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন
১৮ মার্চ ২০২৪
ঢাকা।

মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন

মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন

কবি, কথাসাহিত্যিক ও ছোট গল্পকার

 ফ্রি ই-বুক

রোম্যান্টিক উপন্যাস

সোশ্যাল মিডিয়া লিংক