ভালোবাসার শহরে স্মৃতির কারাগারে

রোম্যান্টিক উপন্যাস

কাহিনি সংক্ষেপ

অরণ্য চৌধুরি, ডাকনাম অরি। পেশায় ফ্যাশান ফটোগ্রাফার। হঠাৎ করেই একদিন নিউইয়র্ক থেকে ডাক পেলো পহেলা বৈশাখের ফটোশুট করার। তার ভেতরটা ধক করে উঠলো। এই সেই শহর, যেখানে তার ছোটবেলার ভালোবাসার মানুষটা রয়েছে। দেখা হয় না প্রায় ষোল বছর। এবার কি তাহলে সেই অপেক্ষার শেষ হতে চলেছে।

ছোটবেলার কোন এক বসন্তের বিকেলে দেখা হওয়া কিশোরী মেয়েটা, ফুটে আছে অরির বুকে নীলপদ্ম হয়ে। গোধুলি রঙের ছায়ায়, অরি কি পারবে তার ভালোবাসার মানুষটাকে ছুঁয়ে দেখতে।

নিউইয়র্কের মাটিতে পা দিতেই অরির পরিচয় হলো ফ্যাশান ডিজাইনার টিনার সাথে। উজ্জ্বল ঝলমলে সুন্দরী তরুণী, এককথায় মায়ায় ভরা ম্যাজিক। কিন্তু, সেই টিনার ভেতরেই যে জ্বলছে পোড়া গোলাপ, তা কে জানতো।

আর এদিকে, বাংলাদেশের অন্যতম টিভি অভিনেত্রী লিরা আবেদ আলী খুঁজে ফিরছে অরিকে, কিন্তু কেন?

কৈশোর থেকে মধ্যবয়েসের ভেতর দিয়ে লেখক তুলে এনেছেন ভালোবাসার নেশা ধরানো এক গল্পকে। এমন একটা গল্প, যেটা মানুষের ভেতরের একাকীত্বের সুরকে বাজিয়ে তোলে তীব্রভাবে।

ভালবাসার শহরে স্মৃতির কারাগারে উপন্যাসটির প্রথম দুটি পর্ব ফ্রি-তে পড়ে দেখুন

ভালোবাসার শহরে স্মৃতির কারাগারে

প্রথম পর্ব – ভোর

নিউ ইয়র্ক শহরে ঘুম থেকে উঠে এত পাখির ডাক শুনতে পাব ভাবিনি।

প্রতিটা মেগাসিটির নিজস্ব কিছু ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক থাকে, যেটা দিয়ে সেই শহরটাকে চোখ বন্ধ করেও চেনা যায়। এই যেমন মসজিদের আজান, রিকশার টুং টাং, বাসের তীব্র হর্ন আর ভটভটানি, ফুটপাতের হকারের ডাক – এই শব্দগুলো আমার কানে এলে বুঝি, এটা আমার শহর, আমার ঢাকা।

একসময় ঢাকাতেও ভোরবেলায় অনেক পাখির ডাক শোনা যেত, কিন্তু আস্তে আস্তে সেই পাখিরা যেন কোথায় হারিয়ে গেল। এখনো মাঝে মাঝে কিছু কাক আর কবুতর দেখতে পাই, কিন্তু এরাও কেমন যেন ঝিম মেরে গেছে, ডাকাডাকি করে না। চুপচাপ বসে থাকে, নয়তো নিঃশব্দভাবে ওড়াওড়ি করে।

আমার মাথার ভেতর যে নিউ ইয়র্ক শহরের ছবিটা আছে, সেখানে আমি দেখি উঁচু উঁচু কাচে ঘেরা দালান, যেগুলোকে স্কাইস্ক্র্যাপার বলে। কালো পিচঢালা রাস্তায় শত শত গাড়ি শোঁ শোঁ করে ছুটে যাচ্ছে, রাস্তার চারদিকে হাই ভলিউমে মিউজিক বাজছে, আশপাশের বিল্ডিংগুলো থেকে বিলবোর্ডের আলোয় চারদিক ঝলমল করছে।

আমি জানালার কাছে এগিয়ে গেলাম পাখিগুলোকে দেখার জন্য।

বাইরে চমৎকার রোদ, ঝলমলে সকাল। নীল আকাশ, ছোট ছোট সাদা কিছু মেঘের টুকরো ধীরগতিতে ভেসে বেড়াচ্ছে। খুব কাছেই বেশ কয়েকটা মাঝারি সাইজের গাছ, সবুজ পাতায় ভরে আছে।

আমি এখন যে বাসাটাতে আছি এটা জ্যাকসন হাইটসের সাঁইত্রিশ নাম্বার এভিনিউয়ের আশপাশে কোথাও। চারতলা বাসা, বাইরের দিকে কার্জন হলের মতো করে লাল রঙের সিরামিক ইটের গাঁথনি দেওয়া। কাল রাতেই জেএফকে এয়ারপোর্ট থেকে ভোর পাঁচটার দিকে এসে উঠেছি এখানে। রাতের অন্ধকার, স্ট্রিট লাইটের আলো আর ক্লান্ত শরীর নিয়ে চারপাশটা তখন খুব একটা ভালো করে দেখার সুযোগ হয়নি। সময় পেলে আজকে এক ফাঁকে এলাকাটা ঘুরে দেখব।

সকালে ঘুম থেকে ওঠার পরপরই সময় দেখতে খুব ইচ্ছে করে। মোবাইল ফোনে টাইম দেখতে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়ায় বছর দশেক হলো ঘড়ি পরা ছেড়ে দিয়েছি।

মোবাইলের স্ক্রিনে সাড়ে এগারোটা বাজে। সময় ঠিক দেখাচ্ছে কি না, কে জানে? রাতে এয়ারপোর্টের ফ্রি ওয়াই-ফাইতে ফোন কানেক্ট করেছিলাম, তখনই ফোনের টাইমটা অটো আপডেট নিয়ে নিয়েছে। এই বাসায় ওয়াই-ফাই আছে কি না, জিজ্ঞেস করা হয়নি, আছে হয়তো।

ইকবাল ভাইয়ের আসার কথা বারোটার দিকে। এলে উনার কাছ থেকে সময়টা জেনে নিতে হবে। ফোনের জন্য একটা টেম্পোরারি সিম কার্ড কেনা দরকার। সব দেশেই পাসপোর্ট দিয়ে টেম্পোরারি সিম কার্ড কেনা যায়। এখানে কোথায় পাওয়া যাবে, সেটাও জানতে হবে। ভাইকে এখন একটা ফোন কল দিতে পারলে ভালো হতো।

হয়তো চলে আসবেন। উনি আসার আগে ফ্রেশ হয়ে নেওয়া দরকার। ক্ষুধাও লেগেছে অনেক, খাওয়ার ব্যবস্থা কী, উনি তা ক্লিয়ার করে কিছু বলেন নাই। শুধু বললেন, অরি, ঠিক আছে তাহলে, এখন তুমি রেস্ট নাও। আমি চলে আসব বারোটার দিকে, যা যা দরকার ব্যবস্থা করে দেব। এটুকু বলে বাসার চাবিটা দিয়ে উনি বেরিয়ে গেলেন। কার বাসা, কী ব্যবস্থা – কিছুই জানা হয়নি। হয়তো, উনিও রাত জেগে ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিলেন।

ওয়াশরুমে ঢুকে মুখে পানি দিতে দিতেই ডোর বেলের আওয়াজ শুনলাম। যাক, ইকবাল ভাই বোধহয় চলে এসেছেন। হাতে-মুখে পানি নিয়েই দরজা খুলতে যেতে হলো।

অরি কী অবস্থা, সব ঠিক, রাতে ঘুম হয়েছে?

জি ভাই, কোনো সমস্যা হয় নাই। শুধু কটা বাজে সেটা ঠিক বুঝতে পারছি না।

উনি উনার ফোনের দিয়ে তাকিয়ে বললেন, এগারোটা পঞ্চাশ এখন।

যাক, আমার মোবাইলের সময় তাহলে ঠিক দেখাচ্ছে।

তুমি বোধহয় ফ্রেশ হচ্ছিলে, যাও… শেষ করে এসো, ব্রেকফাস্ট করতে যাব, বলে ইকবাল ভাই উনার পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেটটা বের করে সোফায় বসে পড়লেন।

বাসার নিচে নেমে আমি বেশ অবাক হয়ে গেলাম। জায়গাটা চেনা আবার অচেনা মনে হচ্ছে। ঢাকার বনানীর পঞ্চাশ নাম্বার রোডের সাথে বেশ খানিকটা মিল আছে, পার্থক্য শুধু বাতাসের গন্ধ।

প্রতিটা শহর যেমন শব্দ দিয়ে চেনা যায়, তেমনই গন্ধ দিয়েও চেনা যায়। এই শহরের বাতাসের গন্ধ আমার কাছে অচেনা, তবে চেনা কিছু গন্ধ মিশে আছে। আশপাশেই হয়তো কোনো ইন্ডিয়ান কিংবা বাংলাদেশি বাসা আছে, সেখান থেকেই পরিচিত কোনো গন্ধ আসছে।

কী খাবে, অরি?

ভাই, আপনি যেটা ভালো মনে করেন। তবে সকালের নাশতাটা স্যান্ডউইচ-বার্গার দিয়ে সারতে চাচ্ছি না।

ইকবাল ভাই আমার দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে বললেন, চলো, দেশি নাশতাই খাওয়াব তোমাকে। পরোটা আর মাংসের কারি, কি চলবে?

চলবে মানে, দৌড়াবে…।

আমি ইকবাল ভাইয়ের সাথে ফুটপাত ধরে হাঁটা শুরু করলাম। কত রকমের মানুষ। ট্যুরিস্ট সিটিতে হাঁটার এটা একটা মজা। রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে নানা দেশের মানুষ দেখা যায়।

ফুটপাতের পাশে একটু পরপরই ছোট ছোট নয়তো মাঝারি সাইজের গাছ। খানিকটা দূরে দূরে ময়লা ফেলার জন্য প্লাস্টিকের ওয়েস্ট বিন রাখা আছে। অল্প একটু হাঁটতেই একটা চৌরাস্তার মতো একটা জায়গায় চলে এলাম।

রাস্তার পাশে দেখি একটা সবুজ রঙের ফুসকার দোকান। ইকবাল ভাইয়ের দিকে তাকাতেই উনি বললেন, এই জায়গাটা হলো জ্যাকসন হাইটসের থার্টি সেভেন এভিনিউ। এটাকে মিনি বাংলাদেশও বলতে পারো, দেশের মোটামুটি সব কিছুই পাবে এখানে। চলো, রাস্তাটা পার হয়ে ওদিকে যাই, বেশ কয়েকটা বাংলাদেশি আর ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট আছে ওখানে।

রাস্তাগুলো বেশ বড়সড়। তবে চোখে পড়ল যেটা, সেটা হলো জেব্রা ক্রসিংগুলো। ঢাকার রাস্তায় জেব্রা ক্রসিংগুলো সব কী করে যেন রাস্তায় নয়তো গাড়ির চাকায় মিশে গেছে। এখানে বেশ সুন্দর করে সাদা রঙের বড় বড় দাগ দেওয়া।

রাস্তাটা পার হতে হতে একটা বড় গ্রোসারি শপ দেখতে পেলাম। ইন্ডিয়ান স্টোর মনে হয়, নামটা দেখে তা-ই মনে হলো। রাস্তা পার হয়ে, ফুটপাতে পা দিতেই মনে হলো বনানী বাজারের কাছাকাছি কোনো জায়গায় চলে এসে পরেছি। ফুটপাতের এক সাইডে সারি সারি দোকান, দোকানের বাইরে কাঠের ছোট ছোট শেলফ – সেখানে কাঁঠাল, আপেল, তরমুজ থেকে শুরু করে নানা রকমের ফল সাজিয়ে রাখা। একটা জায়গায় ফুটপাতের ওপরই বড় বড় ময়লার বিন ব্যাগ রাখা আছে। রাস্তার দুদিকে সারি করে গাড়ি পার্ক করা, গাড়ির চালকরা হয়তো আশপাশেই কোথাও শপিং করছে।

হঠাৎ করে নাকে কাবাবের গন্ধ লাগতেই ইকবাল ভাই বললেন – চলো, এখানে ঢুকে পড়ি। এদের খাবার বেশ টেস্টি, তোমার অনেক ভালো লাগবে।

ভরদুপুরে আমেরিকার নিউ ইয়র্ক শহরে কাবাবের গন্ধে আমার মন এমনিতেই অনেক ভালো হয়ে গেছে।

কাচের দরজা ঠেলে আমরা দুজন ভেতরে ঢুকে পড়লাম।

ভালোবাসার শহরে স্মৃতির কারাগারে

দ্বিতীয় পর্ব – লাইট, ক্যামেরা, অ্যাকশন

দুই মাস আগের ঘটনা।

আমি স্টুডিওতে বসে আছি, ফটোশুট হবে।

আমার ফটো এজেন্সির নতুন ক্লায়েন্ট। সামনের গরমের সিজনে তাদের অরেঞ্জ জুস মার্কেটে ছাড়বে। বিজ্ঞাপনের জন্য ছবি দরকার। আজকেই প্রোডাক্টের ফটোশুট করতে হবে, আবার মডেলের সাথেও জুসের বোতলের ছবি নিতে হবে।

ছবিটা এমন হতে হবে যে, এই প্রেমিক জুটির অনেক গরম লাগছিল, এখন জুস খেয়ে কলিজা ঠান্ডা হয়ে গেছে। মুখে হাসি, চোখে প্রেম।

ক্লায়েন্টের বাজেট কম থাকায় উঠতি দুজন মডেল ম্যানেজ করা হয়েছে। তারা মেকআপ নিয়ে এসি রুমে বসে আছে। বাইরে বের হচ্ছে না, বেরোলেই গরমে ঘেমে মেকআপ গলে যাবে।

দুজন ছেলেমেয়েকে এভাবে এক রুমে রাখা রিস্কি হয়ে যাচ্ছে – হয় বেশি ভাব-ভালোবাসা হয়ে যাবে, নয়তো তুমুল ঝগড়া লেগে যেতে পারে। কিন্তু এখন কিছু করার নেই।

আমি ক্যামেরা, লেন্স আর লাইট রেডি করে বিরক্ত হয়ে বসে আছি – জুসের অপেক্ষায়।

দুপুর থেকে শুনছি, জুস আসছে…

এখন প্রায় সন্ধ্যা, প্রোডাক্টই হাতে পাইনি, শুট করব কখন। মেজাজ খারাপ হয়ে যাচ্ছিল একটু একটু করে।

ক্লায়েন্টের ব্র্যান্ড ম্যানেজারকে এ পর্যন্ত চার-পাঁচবার ফোন করা হয়েছে। প্রতিবারই উনি হাসিমুখে বলছেন, আর দুই মিনিট অরি ভাই, আর দুই মিনিট… জুসের গাড়ি রাস্তায়।

কিন্তু কোথায় সেই গাড়ি…

মডেলদের কস্টিউম কী হবে, সেই ব্রিফটাও দেয়নি। বাজেট ভালো থাকলে একজন কস্টিউম ডিজাইনার, আর একজন ফ্যাশন কো-অর্ডিনেটর নিয়ে নেওয়া যেত।

কামরুল কোত্থেকে যেন একটা লাল রঙের মাথার ব্যান্ডানা এনে আমার মুখের সামনে আন্ডারওয়্যারের মতো করে দুলিয়ে বলল – ভাই, ছেলেটার মাথায় এটা কি পরায় দেব?

এত দিন আমার সাথে কাজ করেও ছেলেটা কাজ শিখতে পারছে না। ফ্যাশন শুট আর কমার্শিয়াল শুটের মধ্যে গুলিয়ে ফেলে।

আমি বললাম, কামরুল, আজকে আমাদের ফ্যাশন হাউসের জামাকাপড়ের শুট না… জুসের শুট। জুসের বোতলের রং থাকবে কমলা, তো আমাদের কি কমলার থেকে ব্রাইট কোনো কালার ফ্রেমের মধ্যে থাকা উচিত হবে… এমন কোনো কালারের কোনো কস্টিউম আর প্ররপ্স দিবা না যেটা দিলে জুসের বোতল মাইর খাইয়া যায়, বুঝছো।

জি ভাই, বলে কামরুল দ্রুত কস্টিউম আর প্ররপ্স রিসেট করতে চলে গেল।

হঠাৎ দেখি মেকআপ আর্টিস্ট ফজলু ভাই, বিড়ালের মতো চুপি চুপি মডেলদের রুমে ঢুকছেন। শুট শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাঁকে স্টুডিওতেই থাকতে হবে। কারণ শুটের সময় একটু পর পর মেকআপের টাচ দিতে হয়, চুল ঠিক করতে হয়।

ছোটখাটো কিংবা কম বাজেটের ফটোশুট থাকলে উনাকে আমি ডাকি না, কারণ উনার চার্জ অনেক হাই। তবে আজকে উনার হাতে কাজ ছিল না। সকাল সকাল আড্ডা দিতে এসে যখন শুনলেন শুট আছে – ভাই আসতেছি, বলে বেরিয়ে গেলেন। ফিরলেন দশ মিনিট পর, সাথে উনার মেকআপ বক্স।

মানুষকে মেকআপ দিতে দিতে তাঁর এখন এমন অবস্থা হয়ে গেছে যে, প্রতিদিন কারো গালে মুখে কিছু ঘষাঘষি না করলে উনার হাত নিশপিশ করতে থাকে।

আমি উনাকে বললাম – ভাই, ওদিকে কই যান?

ফজলু ভাই আমার দিকে তাকিয়ে সুন্দর একটা হাসি দিয়ে বললেন, পুলাপাইনরা বইসা বইসা বোর হইতেছে, যাই ওদের সাথে একটু নাচাগানা করে আসি।

নাচগান করেন, মেকআপ যেন নষ্ট না হয়, জুস কিন্তু দুই মিনিটের মধ্যেই আসতেছে…, বলে আমি আবার ঘড়ির দিকে তাকালামÑ ছয়টা বাজে।

রাত বারোটার আগে আজকে শুট শেষ করতে পারব বলে মনে হয় না।

মেকআপ আর্টিস্ট ফজলু সতেরো বছর আগে ঢাকায় এসেছিল নায়ক হওয়ার জন্য। কিন্তু তার না ছিল নায়কের মতো চেহারা, না ছিল ফাটাফাটি বডি, না ছিল ফিল্মে ঢোকার চ্যানেল।

কিছুদিন এদিক-ওদিকে দৌড়াদৌড়ি করে বুঝে গিয়েছিলÑ এই রাস্তা তার জন্য না।

কিন্তু ইন্ডাস্ট্রি ছাড়তে পারে নাই। এরে-তারে ধরে মেকআপের কাজ শিখে নিল। আর আজকে, মিডিয়া ইন্ডাস্ট্রির এমন কোনো মানুষ নাই যে তাঁকে চেনে না।

মিডিয়ার সবাই জানে – ফজলু এক ঘণ্টা সময়, আর তার মেকআপ বক্স হাতে পেলে পৃথিবীর যেকোনো মেয়েকে হুরপরি বানিয়ে দিতে পারে।

আর মেকআপ দিয়ে মানুষকে শুধু সুন্দর নাÑ কাজের প্রয়োজন বুঝে, চরিত্রের ডিমান্ড বুঝে – সেভাবেই সাজিয়ে তুলতে ওস্তাদ।

বছর দেড়েক ধরে টিকটকে প্রচুর ভিডিও বানাচ্ছে সে। সারাদিন প্রচুর নাচাকুদা করে। যখন যে নায়িকার সাথে কাজ থাকে, তখন তাকে ধরে নিয়েই একটা ভিডিও বানিয়ে ফেলে। এখন তার ফলোয়ার বেইজ কয়েক লাখ।

আমি একদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম, ফজলু ভাই, আপনি পোলাপাইনের মতো করে টিকটকে ভিডিও বানাচ্ছেন, ঘটনা কী? আপনি মেকআপ নিয়ে ভিডিও বানান, ইউটিউবে দেন – মানুষের কাজে লাগবে।

উনি লাজুক হাসি দিয়ে আমাকে বললেন, ‘ভাই, আপনে তো জানেন, আমি নায়ক হইবার চাইছিলাম। তখন সেটা পারি নাই। এখন দেখেন, টিভি-সিনেমার এমন কোনো নায়ক-নায়িকা নাই যে, আমার লগে টিকটকে নাচানাচি করে নাই। তাগো অনেকের থেকে আমার ফলোয়ার বেশি। মানুষ আমারে ভালোবাইসা লাভ দেয় – আমার ওনেক ভালো লাগে ওরিব্বাই… ওনেএএএক ভালো লাগে… আমার মনে, নায়ক না হওনের দুঃখ আর নাই।’

আমার সেদিন মনে হয়েছিল – প্রত্যেকটা মানুষের নিজের কিছু শখ থাকে, ইচ্ছে থাকে। সবার তো সব কিছু পাওয়া হয়ে ওঠে না। এদের মধ্যে কেউ একজন যদি কিশোর-কিশোরীদের মতো নাচানাচি করে অপূর্ণ শখ মেটাতে চায়, তাতে ক্ষতি কী?

শেষবারের মতো ক্লায়েন্টের অফিসে ফোন দেওয়ার জন্য মোবাইলটা হতে নিতেই দেখি আমেরিকা থেকে ইকবাল ভাইয়ের ফোন।

দেশে থাকতে ইকবাল ভাই চারুকলা থেকে পাস করে, একটা ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের এজেন্সি চালাতেন। আমি তখন উনার সাথে অনেক কাজ করেছি বিভিন্ন ক্লায়েন্টের ফটোশুটের জন্য। বছর সাতেক হলো, উনি উনার পুরো ফ্যামিলি নিয়ে আমেরিকায় মাইগ্রেট করে চলে গেছেন ব্যবসাপাতি সব গুটিয়ে দিয়ে। কিন্তু মাঝে মাঝে এখনো ফোন দেন আড্ডা মারার জন্য।

আমি ফোন ধরতেই ইকবাল ভাইয়ের হাসিভরা গলা শুনতে পেলাম –

অরি, কী অবস্থা। ফ্রি আছ পাঁচ মিনিট।

আছি ভাই, বলেন।

আচ্ছা শোন, এপ্রিলে পহেলা বৈশাখে নিউ ইয়র্কে বাংলাদেশের মতো খুব সুন্দর করে প্রোগ্রাম করা হয়, জানো তো! এবারের বৈশাখের ইভেন্টটা আমি কো-অর্ডিনেট করছি। তো, আমি চাচ্ছিলাম তুমি এবার আমাদের এখানে নিউ ইয়র্কে এসে আমাদের প্রোগ্রামটা শুট করো।

দুম করে এমন একটা প্রস্তাব পেয়ে আমি খানিকটা ভড়কে গেলাম।

দেশের ভেতরই এখন ফটোশুটের কাজ জোগাড় করতে ঘাম বেরিয়ে যাচ্ছে, সেখানে ইউএসএ থেকে কাজ আসা তো বিরাট ব্যাপার। কিন্তু আমার বুকের ভেতর ঢিপ ঢিপ করছিল, অন্য আরেকটা কারণে…

নিউ ইয়র্ক নাম শুনলেই হয়তো সবার মনের মধ্যে নিউ ইয়র্ক হারবারের পাশে দাঁড়ানো স্ট্যাচু অব লিবার্টির কথা মনে হয়, যেখানে রোমান দেবী লিবার্টাসের অনুকরণে তামার তৈরি হালকা ফিরোজা রঙের মূর্তি দাঁড়িয়ে আছে – যার বাঁ হাতে টাবুলা আনসাটা, আর ডান হাতে উঁচু করে ধরা মশাল। কিন্তু আমার মনের ভেতর নিউ ইয়র্কের সাথে অন্য একজনের চেহারা মিশে আছে।

আমার ভাবনাটা সেদিকে যেতেই ইকবাল ভাইয়ের – হ্যালো… হ্যালো, শুনতে পেলাম।

জি ভাই, শুনতে পারছি, আমার কোনো সমস্যা নাই। কিন্তু আপনি এত টাকা খরচ করবেন কেন? ওখান থেকেই কোন ফটোগ্রাফার হায়ার করলে ভালো হতো না?

শোন, ইভেন্ট করতে করতে আমি বুড়া হয়ে গেলাম। টাকার হিসাবে আমি খুব ভালো বুঝি। তোমার এগুলো নিয়ে ভাবতে হবে না। তোমাকে এখন থেকে ইনভাইটেশন পাঠাতে আমার কিছু ডকুমেন্ট লাগবে। আমি তোমার ই-মেইলে সেগুলো পাঠিয়ে দিচ্ছি। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পাঠিয়ে দাও আমাকে, যাতে ভিসাটা আগেভাগে হয়ে যায়। হাতে সময় খুব একটা নেই, এখন ফেব্রুয়ারি… আর দু’মাস পরেই বৈশাখ।

ওকে ভাই, আপনে মেইল করেন। আমি পাঠিয়ে দিচ্ছি।

ঠিক আছে, আজকে ছাড়ছি। পরে আবার ফোন দেব নে। তবে আমার ইভেন্টের জন্য তোমার শুটের শিডিউল কিন্তু লক করলাম, অ্যাডভান্স লাগলে বলো।

অন্য কেউ হলে অ্যাডভান্স না নিয়ে কাজ করতে রাজি হতাম না। কিন্তু ইকবাল ভাইয়ের কাছে তো আর সেটা চাওয়া যায় না। কারণ, উনার কারণেই আমি ক্যারিয়ারের শুরুতে অনেক কাজ পেয়েছি। উনি না থাকলে হয়তো আজকে আমি প্রফেশনাল ফটোগ্রাফার – অরণ্য চৌধুরী হিসেবে কখনোই দাঁড়াতেই পারতাম না।

– ভাই, আপনে কি মজা নেন, বলে আমি একটু হাসি দিলাম।
– ওকে, ঠিক আছে। আজকে রাখি। ভালো থেকো।
– বাই… ভাই, বলে ফোনটা টেবিলে রেখে দিলাম।

আমেরিকার ভিসা পাওয়া নিয়ে অনেক আজেবাজে গল্প শুনেছিলাম। কিন্তু ইকবাল ভাইয়ের পাঠানো ইনভাইটেশন লেটার, রিটার্ন টিকিট আর অন্যান্য ডকুমেন্ট নিয়ে ইউএস এম্বাসিতে ভিসার জন্য অ্যাপ্লাই করার পর খুব তাড়াতাড়িই ভিসা হাতে পেয়ে গিয়েছি। সাত দিনের জন্য না, একেবারে পাক্কা পাঁচ বছরের জন্য মাল্টিপল ভিসা।

প্রকৃতির যখন দেওয়ার ইচ্ছে হয়, তখন সব কিছু বোধহয় উজাড় করেই দেয়।

অরি ভাই, অরি ভাই… জুস আইসা গেছে…, হাঁপাতে হাঁপাতে এসে বলল আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট বুলবুল।

গুড, স্টুডিওর লাইটগুলো অন করে দে… আর ওই দুটাকে এসি রুম থেকে বের কর, বলে আমি হাতের আধ খাওয়া সিগারেটটা অ্যাশট্রেতে নিভিয়ে দিলাম।

ফটোশুট একটা নেশার মতো জিনিস। যখন কাজ শুরু হয়, নেশা লাগতে শুরু করে। স্টুডিও রুমের মিউজিক অন হয়ে গেছে… দরজার ফাঁক গলে লাইট বের হয়ে আসছে।

বাইরে সন্ধ্যা নেমে পড়েছে।

আমি ক্যামেরা হাতে স্টুডিও রুমের দিকে এগিয়ে গেলাম।