এক

বৈশাখ মাসের তাতালো গরম। রাস্তার পিচ গলে যায় এমন অবস্থা। আকাশের দিকে একটু তাকালেই চোখ ঝলসে যাচ্ছে। কতোগুলো কাকের দল রাগ দেখিয়ে এলোমেলো ভাবে আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছে।

রাস্তার মেইন রোডে ট্রাফিক সিগন্যালে আটকে আছে – রংবেরঙের গাড়ি, সবুজ কচুপাতায় বসে থাকা ব্যাঙের মতো সিএনজি, আবস্ট্রাক্ট আর্টের জ্যাকেট পরা লোকাল বাস, উলঙ্গ মশার মতো অসংখ্য রিকশা।  

আর, এই জ্যামের ভেতর একটা সিএনজিতে বসে আছে শফিক। দূর থেকে তাকে দেখে মনে হচ্ছে খাঁচার ভেতর আটকে আছে একটা বাঁদর। দরদর কর ঘামছে সে। একটু পর পর পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখের ঘাম মুছছে। 

মানুষের জীবনে কতো অদ্ভুত ধরণের প্যারা নিতে হয়। এই যেমন আমাদের শফিক। তার নিজের কিন্তু এসিওয়ালা নতুন মডেলের একটা প্রাইভেট কার আছে। কুড়ি হাজার টাকা মাইনে দেওয়া একজন ড্রাইভারও আছে। 

তারপরও তাকে লোহার খাঁচার সিএনজিতে করে আজকে বের হতে হয়েছে। গরমে বসে সেদ্ধ হতে হচ্ছে। এমন না যে তার গাড়িটা নষ্ট কিংবা গ্যাস নেই। এভাবে তাকে যেতে হচ্ছে কারণ, সে যেখানে যাচ্ছে সেখানে নিজের গাড়ি নিয়ে যাওয়া যাবে না। এমন না যে সেখানে গাড়ি ঢোকে না। সমস্যা হলো ইনফরমেশন লিক হয়ে যাবে। গাড়ির ড্রাইভার হচ্ছে সবচে ভালো ইনফরমেশন পাচারকারি। শফিক চায় না তার এই গোপন ব্যাপারটা তার বউ জেনে যাক।

এই সিগন্যাল আসলে কতক্ষণ আটকে থাকতে হবে কে জানে। শফিক মনে মনে অস্থির হয়ে উঠলো। ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখলো একটা দশ বাজে। দুপুরের এই লাঞ্চ টাইমটাতে অফিসে কাজের প্রেশার একটু কম থাকে। এই সময়টাকেই কাজে লাগিয়ে সে মাঝেমধ্যে অফিসের বাইরে একটু এদিক ওদিক যায়। বিকেল চারটা নাগাদ আবার অফিসে ফিরে আসে।

রাস্তার গাড়ি একটাও নড়ছে না। শফিকের মনে হচ্ছে আধ ঘণ্টা ধরে সে একই জায়গায় বসে আছে। 

মাঝে মাঝে মনে হয়, এই শহরটা একদিন স্থবির হয়ে যাবে। সবাই রাস্তায় আটকে যাবে। রাস্তায় বসে খাবে, রাস্তায় বসে জুম কলে অফিস করবে। রাগে শফিকের মুখে থুতু উঠতে শুরু করলো। সে সিএনজির খাঁচার ভেতর থেকে পানের পিকের মতন করে বাইরে থুতু ফেলার চেষ্টা করলো। কিন্তু, প্র্যাকটিস না থাকায়, সে থুতুটা বাইরে ফেলতে পারলো না। তার আঠালো লালা সিএনজির শিকের মধ্যে আটকে গেলো। রোদের আলো পড়ে সেটা এখন খানিকটা চিকচিক করছে।

হাতের ফোনটা বাজতেই শফিক স্ক্রিনে কলারের নাম দেখলো – “নেপাল ব্রাঞ্চ”। এই ফোনটা তার অফিসের নেপাল কোন ব্রাঞ্চ অফিস থেকে আসেনি। 

যার কাছ থেকে এসেছে তার নাম – নেহা।

এই নিয়ে এরমধ্যে তিনবার ফোন এলো। শফিকের ঘাড়ের কাছে একটা ব্যাথার চাপ অনুভব করলো। হঠাৎ করে প্রেশার উঠলে তার এমন হয়।

নেহা শফিকের অফিসের কোন কলিগ না। তার আত্মীয়স্বজনেরও কেউ না। এমনকি তার বউও না।

তাহলে মেয়েটা কে?  শফিকের সাথে তার পরিচয় কোথায়? তাদের মধ্যে সম্পর্ক কি? – এগুলো জানতে ইচ্ছে করছে। এক মিনিট। সেগুলোতে একটু পড়ে আসছি। আগে আমরা শফিককে ফোনটা ধরতে দেই। বেচারা এমনিতে চাপে আছে, ফোন ধরতে দেরি হলে তার চাপ আরও বেড়ে যাবে। প্রেশার বেড়ে গিয়ে রাস্তার মধ্যে ছোটখাটো একটা স্ট্রোকও হয়ে যেতে পারে। 

পঁয়তাল্লিশ বছর বয়েসের আশপাশটা আসলে খুব গোলমেলে। শরীর আর মন দুটোই বেয়াড়া হয়ে যায়।

শফিক ফোনটা রিসিভ করতেই ওপর প্রান্ত থেকে আদুরে এক মেয়েলী কণ্ঠ শোনা গেলো – জান সোনা তুমি কোথায়? আর কতো দেরি করবা। আসো না তাড়াতাড়ি।

– এইতো আমি রাস্তায়। একদম তোমার বাসায় কাছে। জাস্ট আর দশটা মিনিট অপেক্ষা করো। আমি আসছি
– তুমি তো সেই আধ ঘন্টা ধরেই বলছো, দশ মিনিট। দশ মিনিট। তাড়াতাড়ি আসো না। তোমার জন্য আমি লাঞ্চ রেডি করে রেখেছি। তুমি এলে একসাথে খাবো।
– সরি জান। সত্যি আর দশ মিনিট।
– ওকে তাড়াতাড়ি আসো…

নেহা ফোনটা রেখে দিলো।

রাস্তার ট্রাফিক সিগনাল ছেড়ে দিয়েছে। শফিক স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। যাক। সামনের রাস্তার বামে ঢুকলেই আর চিন্তা নেই। এরপর গলির ভেতর দিয়ে যেতে বড়জোড় দু তিন মিনিট।

ভেতর রাস্তা দিয়ে যাবার সময় একটা ফার্মেসির দোকানের সামনে আসতেই শফিক বলল, অ্যাই একটু বামে চাপাও তো। একটা ওষুধ নেবো। 

এখান থেকে হেঁটে গেলে নেহার অ্যাপার্টমেন্ট এক মিনিটের হাঁটার পথ। শফিকের মনে হলো এটুকু রাস্তা হেঁটে যাওয়াই ভালো। সিএনজি থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে সে ওষুধের দোকানে ঢুকে পড়লো।

ছোট একটা দোকান। ভেতরে পচিশ ত্রিশ বয়েসের একটা ছেলে বসে আছে। শফিক সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই ছেলেটা জিজ্ঞেস করলো, স্যার কি ওষুধ লাগবে?

– তোমার এখানে কনডম আছে?
– আছে স্যার।
– দাওতো এক প্যাকেট।
– কোনটা দেবো স্যার।
– আরে, দাও একটা।

হঠাৎ করেই শফিকের টেনশন লাগা শুরু হলো। কোন কারণ ছাড়াই। সে প্যান্টের পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেটটা বের করে দেখলো সাতটা আছে। সকালে দশটা কেনা হয়েছিলো। এরমধ্যে তিনটা শেষ। বাকি দিনটা এগুলো দিয়েই চলতে হবে। ধরাবে কি ধরাবে না, ভাবতে ভাবতেই সে একটা ধরিয়ে ফেলল। 

দোকানের ছেলেটা একটা ছোট কাগজের প্যাকেটে কনডমের বাক্সটা ভরে শফিকের দিকে এগিয়ে দিলো। স্যার, এই যে আপনার জিনিস।

শফিক একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলো, বলল, হু… কি বললে… ও হ্যাঁ… এই যে টাকাটা রাখো। প্যাকেটা পকেটে ভরে সামনের দিকে হাঁটা দিলো সে। 

আচ্ছা, দশ মিনিট কি পার হয়ে গেলো।

এতো টেনশন জীবনে। এতো টেনশন। নতুন আর কোন টেনশন নেয়া যাবে না, ভাবতে ভাবতে দ্রুত গতিতে হাঁটতে লাগলো শফিক। 

ছয়তলা বাসা। সাউথ ফেসিং। এর আগেও শফিক কয়েকবার এসেছে। এটার পাঁচ তলায় থাকে নেহা। অ্যাপার্টেমট নাম্বার – ৫/বি। লিফটের চার। 

লিফট খুলতেই শফিক লিফটের ভেতর ঢুকে পড়লো। আর ঢোকার সময় সে দেখলো, তার পেছন পেছন একটা বড় সাইজের বানর তার সাথে লিফটের ভেতর ঢুকছে।

কি অদ্ভুত… 

এখানে বানর এলো কোথায় থেকে!

লিফটের ভেতর একদম শফিকের সামনেই দাঁড়িয়ে আছে। জলজ্যান্ত একটা বানর। কিয়েক্টাবস্থা।

আর, কিছু ভাববার আগেই লিফটের দরজা বন্ধ হয়ে গেলো।

.
.

ছোটগল্পঃ বানর (১ম পর্ব)

একুশের বইমেলার জন্য এবার বেশ কতগুলো ছোটগল্প লিখছি। সেই গল্পগুলোর একটা – বানর।
গল্পটার প্রথম পর্ব পোষ্ট করতে মন চাইলো আজকে, তাই করে দিলাম।

এই ছোটগল্পগুলো বাস্তব, অবাস্তব আর পরাবাস্তবের মিশেলে তৈরি করা। জানি না পাঠকদের কেমন লাগবে।

লেখালেখি নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করতে আমার ভালো লাগে। কিন্তু, এই এক্সপেরিমেন্টে রিস্ক থেকে যায়।
ভাবলাম এবার রিস্কটা নিয়েই ফেলি। পরে দেখা যাবে কি হবে।

সময় দিয়ে পড়ার জন্য ধন্যবাদ।
.
.
মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন
২ অক্টোবর ২০২৪
ঢাকা।

মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন

মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন

কবি, কথাসাহিত্যিক ও ছোট গল্পকার

 ফ্রি ই-বুক

রোম্যান্টিক উপন্যাস

সোশ্যাল মিডিয়া লিংক